নূর মোহাম্মদ, আইএনবি নিউজ: বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে ব্যাপক হারে বাড়ছে এইচআইভি ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা। যা পুরো বাংলাদেশী বিশেষ করে কক্সবাজারে বসবাসরতদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামাজিক ও যৌন রোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং ধর্মীয় কুসংষ্কারের কারনে রোহিঙ্গাদের মাঝে এ রোগের ঝুঁকি দিনদিন বাড়ছে। মিয়ানমান থেকে আসা রোহিঙ্গারাদের মধ্যে এইডস সৃষ্টিকারী এইচআইভি ভাইরাস এবং নানা যৌন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি সংখ্যা গত কয়েক মাসে উদ্বেহজনকহারে বেড়েছে।
এদিকে কক্সবাজার, বিএসএমএমইউ, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা এ ৫টি বড় হাসপাতালে এবং দেশের ২৩টি সেন্টারে এ রোগের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ অধিকাংশ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানেই মরণব্যাধি এইডসের চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সেন্টারে এ সেবা দেয়া হলেও ১৬ কোটি মানুষের জন্য খুবই নগন্য। এর সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা এ রোগ বিস্ত্মারের পথে নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার প্রকাশিত সর্বশেষ ডাটা অনুযায়ী, কক্সবাজারে বসবাসকারী শরণার্থীদের মধ্যে ৩৯৫ জন রোহিঙ্গা এই ভাইরাসে আক্রান্ত। এ বছর নতুন ১০৫ জনের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত এইচআইভি সংক্রমণে মারা গেছেন ১৯ জন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন সরকারি এই সংখ্যার চেয়ে আক্রান্তদের প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে। তারা সরকারকে এখনই এ রোগের বিস্তার রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে আসার দু-এক মাস পরেই বাংলাদেশ সরকার বেসরকারি সংগঠনগুলোর সহায়তায় রোহিঙ্গাদের মেডিকেল টেস্ট সম্পন্ন করে। এ সময় ৮৫ জনের দেহে এইচআইভি পাওয়া যায়। তারপর থকে এই সংখ্যা বাড়ছেই। মেডিকেল সায়েন্স বিষয়ক প্রকাশনা ও ল্যান্সেন্ট একটি জরিপ পরিচালনা করে। তাতে দেখা যায়, ২০১৮ সালের আগস্টে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে সরকারিভাবে ২৭৩ জনের দেহে এইচআইভি আছে বলে রেকর্ড করা হয়েছে। এই সংখ্যা ২০১৯ সালের ৮ই মার্চে এসে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৯-এ। এক্ষেত্রে আরো অনেক মানুষের পরীক্ষা সম্পন্ন হয়নি। ৩১৯ জনের দেহে এইচআইভি ভাইরাস পাওয়া যাওয়ার পর ২৭৭ জন চিকিৎসা নেয়া শুরু করেছেন। মারা গেছেন ১৯ জন।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি যে ডাটা প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৩৯৫ জন এইচআইভিতে আক্রান্ত। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইচআইভির বিস্তারের নেপথ্যে রয়েছে অসচেতনতা। রয়েছে সামাজিক নানা কুসংস্কার। এসব মিলে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। অন্য সব রক্ষণশীল সমাজের মতোই কারো দেহে এইচআইভি পাওয়া গেলে তাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞতা বলছেন, ওই ব্যক্তির দেহ থেকে এইচআইভি ছড়াতে পারে। আবার যাদের দেহে এই ভাইরাস পাওয়া গেছে তারা চিকিৎসা নিতে গড়িমসি করেন। কক্সবাজারে নিয়োজিত একজন চিকিৎসক মোহাম্মদ আবদুল মতিন বলেন, অনেক রোহিঙ্গা এইচআইভিকে জ্বর, ঠাণ্ডার মতো সাধারণ অসুস্থতা হিসেবে দেখে থাকেন বলে মনে করেন ঢাকা ভিত্তিক পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেইনিং সেন্টারে কমর্রত মেডিকেল অফিসার আসিফ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদেরকে এই রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে বোঝানো খুবই কঠিন। অনেক রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসরণই করেন না। বিশেষ করে যখন তারা যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ভয়াবহতার আরো অবনতি থেকে প্রতিরোধ করতে কর্তৃপক্ষের উচিত অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইচআইভি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং তাদের শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা। এতে আরো বলা হয়, বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা খাতকে এমনভাবে শক্তিশালী করা উচিত, যাতে নতুন এইচআইভি রোগী শনাক্ত ও তাদেরকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়। এইচআইভিকে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক এজেন্সিগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য অনেক আন্তর্জাতিক এজেন্সি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এসব সংগঠনও রোগীদের এইচআইভি শনাক্তে সহযোগিতা করছে। কিন্তু কয়েক লাখ শরণার্থীকে মানবিক সহায়তার পাশাপাশি এইচআইভি স্ক্রিনিং করার ক্ষেত্রে এসব তৎপরতা যথেষ্ট নয়। চিকিৎসক আবদুল মতিন বলেন, শরণার্থীদের এই ক্যাম্পে এইচআইভি স্ক্রিনিং সেন্টার বৃদ্ধি করা খুব বেশি প্রয়োজন। ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমার উভয়ই এইচআইভি ডেঞ্জার (অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ) জোন বলে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার প্রতিবেদনেও জানানো হয়েছে। তবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণে এত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যেও বাংলাদেশ সবচেয়ে কম ঝুঁকির দেশের তালিকায় রয়েছে। আর ঝুঁকিপূর্ণ মিয়ানমার থেকে আসা নাগরিকদের মধ্যে একটি বিরাট সংখ্যক এরই মধ্যে এইডস শনাক্ত করা হয়েছে, যা মোকাবেলা করার মতো প্রস্তুতি এ দেশের নেই। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে এইডসমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা এমনকি বিভাগীয় শহরেও এ রোগের চিকিৎসা সেবা এখনো অপ্রতুল। তাই রোগ নির্মূলে আক্রান্ত্মদের চিকিৎসার পাশাপাশি এইচআইভি টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সিলিং, পজেটিভ লিভিং কাউন্সিলিং, পুষ্টি ও নিরাপদ যৌন উপকরণ চিকিৎসাসহ নানা কর্মসূচির ওপর জোর দেয়ার আহ্বান জানান তারা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. আবু জাহের আইএনবিকে বলেন, এনএসএসটিডি প্রোগ্রামটি মূলত সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগীয় দপ্তরের কর্মসূচি। এটি ঢামেকের কোনো উদ্যোগ না। মূলত রোগটির চিকিৎসায় গেস্নাবাল ফান্ড বন্ধ এবং বেসরকারি প্রকল্পটির মেয়াদ শেষের ফলেই সরকারের কর্মসূচিটিও বন্ধ আছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরেক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত্ম বাংলাদেশে নতুন করে এইচআইভিতে আক্রান্ত্ম রোগীর সংখ্যা ছিল ৪৬৯ জন। এর মধ্যে মারা যান ৯৫ জন। এছাড়া ১৯৮৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত্ম মোট এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত্মের সংখ্যা ৪ হাজার ১৪৩ জন এবং এইডস রোগে মৃত্যু হয়েছে ৫৬৯ জনের।
আইএনবি/এনএম