এমডি বাবুল ভূঁইয়া: কোথায় থেকে শুরু করব বুঝতে পারছিনা। জীবনকাল থেকে প্রায় ৪৪ বছর অতিক্রম হয়ে গেছে। শৈশবে কত সুখ আর শান্তি ছিল মনে। কৈশোরে পড়াশুনার পাশাপাশি স্কুল জীবনের বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকতাম। কত বকুনি খেয়েছি মায়ের মুখে, তবুও বন্ধুদের সঙ্গ ছাড়তে পারিনি। নানা ভাবে বন্ধুদের মাঝে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুনসুটি করেছি, ঝগড়া করেছি। আমার অশান্ত এই মনে কত কথা লুকিয়ে আছে তার ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝানোর মতো ভাষা আমার জানা নেই…।
আজ বয়সের প্রায় অনেক অংশ পারি দেওয়ার পরও সেই অনুভূতি গুলো যখন মনে পরে তখন বড়ই মধুর লাগে। কখনো আবেগে আপ্লোত হয়ে চোখের কোনে পানি জমে যায়। এরই নাম হয়তো বন্ধুত্ব। বন্ধুহীন জীবন অনেক কঠিন ও কষ্টের, যা প্রতিটা মুহুর্তে আমি টের পেয়েছি। যদি কর্মময় জীবনে অনেক বন্ধ-বান্ধব পেয়েছি। তথাপিও বাল্যকালেে সেই স্কুল জীবনের বন্ধু গুলোকে কখনো ভুলা যায়না, আমার কাছে সেই বন্ধুদের সবার সেরা বলে আমি মনে হয়। ।
কারন হিসেবে কয়েক লাইন বলতে চাই-
স্কুল জীবনের বন্ধুদের সাথে ঝগড়া হয়েছে কথা কাটাকাটি হয়েছে কিন্তু হিংসা বিদ্বেষ ছিলো না। কেউ কখনো বন্ধুকে বিপদে ফেলার বা মেরে ফেলার চিন্তা মাথায়ই আসতোনা। অথচ কর্মময় জীবনে এক কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্যে চলতে হয়। সেখানে কোন বিষয়ে রাগ অভিমান হলে সেইটা অনেক দুর এগিয়ে চলে যায়। যার জন্য হত্যা পযর্ন্ত করে ফেলে যা আমি বাস্তবে দেখেছি। আমি বলছিনা সর্বক্ষেত্রে এমনটা হচ্ছে। তবে বেশির ভাগই হচ্ছে হিংসা বিদ্বেষে ভরা। এটা বর্তমান সমাজের অনেকটাই বাস্তব চিত্র হয়ে দাঁড়িছে। অসুখ-বিসুখ সহ বিভিন্ন সমস্যা হলে আশ পাশের প্রতিবেশি বা অফিসের কলিগ গুলো ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে হয়তোবা পাশে দাঁড়াবে বা খোঁজখবর নিয়ে থাকে যা শুধুই অল্প কিছু সময়ের জন্য। বেশির ভাগই আমি তাই দেখেছি । কিন্তু স্কুল এবং বাল্য কালের বন্ধু গুলো কখনো এমনটা করেনা। যা আজও আমি বুঝতে পেরেছি। সেই বন্ধু গুলোর মাঝে শত ঝগড়া, খুনসুটি থাকলেও একজনের সমস্যা বা বিপদের কথা শুনে ছোঁটে দৌঁড়ে আসে যা আবারও প্রমানিত হলো জীবনের ৪৪ বছর বয়সে এসে।
আজ আমি প্রায় ২৫ বছর পর ফিরে পেয়েছি স্কুল জীবনের সেই বন্ধু গুলোকে। আমাদের বন্ধ-বান্ধবীদের একত্রে করার জন্য বন্ধু হীরা উদ্যোগ গ্রহন করেছিল বন্ধু খোকনের সাথে। তারই ধারাবাহিকতা আমার শৈশব এবং কৈশোরকাল ও স্কুল জীবনের একসাথে অনেকটা পথচলা বন্ধু শফিকুল ইসলাম খোকন এর প্রাণবন্ত প্রচেষ্টায় আমরা একত্রিত হয়েছি আধুনিক ডিজাটাল প্রযুক্তি হোয়াটস এপ এর মাধ্যমে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই হীরা এবং খোকনকে তাদের এই মহতি উদ্দ্যোগের জন্য।
আজ একাকিত্বকে হারিয়ে নতুন আঙ্গিকে সেই কৈশোরের স্কুল জীবনের সময়টাতে দিনের অনেকটা সময়ই আমি হারিয়ে যাই। সেখানে কিছু বললে বা লিখতে গিয়ে সেই ১৬/১৮ বছর বয়সের জীবনে চলে যাই। সেখানে কিযে লিখি বা বলি আমি নিজেই জানিনা। যখন একা একা আবার পুনরায় লেখা গুলো পড়ি তখন আমি নিজেই হাসতে থাকি। তার জন্য স্ত্রী ও ছেলের কাছে পাগল উপাধীও পেয়েছি। তাতাওে আমি খুব আননন্দিত।
আমাদের গ্রুপের অনেক বন্ধুদের আমি মনে রেখেছি। যখন তাদের কথা শুনি বা তারা যখন কিছু লিখে, তখন স্কুল জীবনের সেই চেনা জানা মুখগুলো চোখে ভেসে উঠে। হয়তো বর্তমান বয়সের বাড়ে অনেকের গঠনই পরিবর্তন হয়েছে। কেউ কেউ আবার শত পরিচয় দিলেও চিনতে পারেনা। অনেক কষ্ট করে তাদের স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে হয়। এরই নাম হয়তো বন্ধুত্বের বন্ধন।
আমাদের বন্ধুদের মাঝে আফসার ছিলেন ক্লাসের ফাস্ট বয়। খুবই মেধাবী এবং ভাল ছাত্র ছিল। সেইদিক দিয়ে আমরা একটু পিছিয়ে ছিলাম। আফসারকে আমরা বেশির ভাগই ভূঁইয়া নামে ডাকতাম, তার সঙ্গী ছিল শাহ্-আলম ও মাহাবুব ওরফে দরবেশ। মেয়েদের মধ্যে ডালিয়া, রুমানা, মনি, ইতি, নাজনীন এগিয়ে ছিল। তাই ওদেরকে সহজেই সবাই মনে রেখেছে। তারপরও খোঁজে পেয়েছি ফারহানা, শামীমা, শাহিদা ও ছালমাকে। হয়তো আরো অনেক বান্ধুবীদের খোঁজে পাবো।
আমাদের গ্রুপে জয়েন্ট হয়েছে বন্ধু হীরা, শরিফ, বিল্লাল, এমরান, শাহিন, আক্তার, মোর্শেদ, মাহাবুব, রাসু, জিয়া,মাজারুল, আশরাফ, জাহাঙ্গীর, হারুন, মহিউদ্দিন মজুমদার ও তার ভাই সেলিম মজুমদার, ওবায়দুল, শামীম, খাইরুল সহ আরো অনেক বন্ধুরা।
ছোট থেকে স্কুল জীবন পেরিয়ে কলেজেও আমি আর খোকন এক সাথেই ছিলাম। রীতিমতো আমি আর খোকন একটা জোট ছিলাম। আমাদের দুজনের মাঝে অনেক ঝগড়াও হতো, আবার নিমিষেই মিলে যেতাম। আমরা যে এলাকায় থাকতাম সেখানের কিছু মানুষ ঈর্ষাম্বিত হয়ে আমাদের পছন্দ করতোনা। তাতে আমারা কর্ণপাত করতাম না। তখন আমাদের সাথে হীরা এসে মাঝে মাঝে আড্ডায় যোগ দিতো। হীরাদের বাসায় কত আড্ডা কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে যা আজও ভুলতে পারিনা। এমরান, মাজারুল, শাহিনের সাথেও রয়েছে ছোট বেলার অনেক স্মৃতি। আমরা যখন একসাথে দল বেধে পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম তখন এমরান, শাহিন সহ আমাদের সাথে যোগ দিতো শিরিন, জিয়া, শামীমা, ফারহানা, লতা ও তার ভাই বন্ধু শামীম, বিলকিস, আমার বড় বোন স্বপ্না সহ আরো কয়েকজন ছিলাম।
শামীমা ও ফারহানাকে আমি অনেক রাগিয়েছি। ফারহানাকে ইদুর বলে ডাকতাম। তখন সে খুব রাগ করতো। কারন ফারহানার চোখ গুলো একটু ছোট ছিল। জানিনা ফারহানার এই কথা গুলো মনে আছে কিনা।
শৈশব ও কৈশোরের এত স্মৃতি মিশে আছে বন্ধুদের সাথে যা লিখে বা বলে শেষ করা যাবেনা। শুধু এতটুকু বলতে পারি এইসব বন্ধুদের চেয়ে আপন এবং কাছের বন্ধু আমার নেই। এরাই হলো আমার প্রকৃত বন্ধু।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো আজও গ্রুপে বন্ধুদের সাথে আমাদের রাগ অভিমান হয়। কয়েকজন বন্ধুতো গ্রুপ ছেড়ে চলেই গেল। তাদের আবার বুঝিয়ে গ্রুপে ফিরিয়ে এনেছি। সেখানে ডালিয়াও জোড়ালো ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এই রাগ অভিমানটাকে আমি খুব এনজয় করি। গ্রুপে লেখালেখির মাঝে খোকনের সাথে এখনো আমার রাগ অভিমান হয়ে থাকে। বলতে গেলে দুজনের মধ্যে রীতিমতো যোদ্ধ শুরু হয়। যদিও খোকন অনেকটা সময় চুপ থাকে। কিন্তু আমি চাই সে আমার সাথে রাগ করুক। তার সেই ছোট বেলার অভিমান করা মুখটা আমি দেখতে চাই। সত্যিই সে যখন রাগ করে আমি তখন কল্পনার সাগরে ভেসে যাই। খোকনের সেই মলিন ও শুকনো মুখটা আমি খোঁজে বেড়াই। কিন্তু আমার মনের এই কথাটা খোকন এখনো বুঝতে পারেনি। আর বুঝতে না পারার জন্যই আজ আমি বন্ধুদের নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণ লেখা লিখতে পেরেছি। তারজন্য খোকনকে অনেক ভালবাসা জানাই।
শরিফ ও রাসুর কথা কি আর বলবো,এক কথায় দুজনই কমেডি হিরো। হাসাতে হাসাতে পেট ব্যথা করে ফেলতো। এখনো সেই আগের মতোই আছে এই দুজন। শরিফ ও আফসার অনেক ভাল কবিতা লিখে। আমি তাদের লেখা কবিতা পড়ে-তো রিতিমত অবাক হয়ে গিয়েছি। কারণ, আগে কখনোও দেখিনি তাদের কবিতা লিখতে। শরিফের গানের কন্ঠটাও দারুন। যেকোন গানের সুর নকল করে সহজেই বন্ধুদের নিয়ে গান বানিয়ে ফেলে। এইতো সেদিন বিল্লাল, ডালিয়া এবং আমাকে নিয়ে গান বানিয়ে গ্রুপে দিয়ে দিলো। যদিও আমরা মজা করেছি কিন্তু তার গলায় এখনোও আগের মতো সুর ধরে রেখেছে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো- আমি নিজের অজান্তেই আমাদের গ্রুপে বন্ধুদের কাছে কমেডি হয়ে গিয়েছি। দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা রাইটিং দেওয়ার চেষ্টা করি, বিশেষ করে ময়মনসিংহের ভাষাটা ব্যবহার করি। যদিও আমার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ নয়। তাতে নাকি সবাই এনজয় করে। আমি তোতাপাখি (ফারহানা), ডাক্টর (হীরা) , মাজার (মাজারুল), পাউন্ড (ডালিয়া), বিজলি (রুমানা), বিলু (বিল্লাল), মুন্সি (শরিফ), নাডা (রাসু) এই নামে গ্রুপে ব্যবহার করি। যদিও খোকন সেইটা পছন্দ করেনা। তার মাঝে এখন অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু তাকে ক্ষেপাতে আমি খুব মজা পাই।
কর্মময় এবং সংসার জীবনে সবাই যার যার অবস্থানে খুব ভাল আছে জানতে পেরে অনেক খুশি হয়েছি আমি। এমরান কাতারে, হীরা সৌদি দুতাবাসে, বিল্লাল লেবাননে, আতিক সৌদি আরবে, খোকন এবং শরিফ ব্যবসা করছে, শাহিন পরিবার নিয়ে থাকে ফ্রান্সে,ডালিয়াও তার স্বামীর সাথে লন্ডনে আছে, ফারহানা ভুমি অফিসে কর্মরত, ইতি ও ছালমা বিদুৎ অফিসে, আমাদের আরেক বান্ধবী মাসুদাও বিদুৎ অফিসে চাকরী করছে। এখানে আমার অনুভূতির কিছু কথা প্রকাশ করেছি মাত্র…..। আমি মরে গেলে এই লেখাটুকুর কারনে হয়তোবা বন্ধুদের কাছে স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকব। অনেক না বলা কথা জমে আছে মনের গভীরে। আজ আমার অসমাপ্ত লেখাটুকু বন্ধু শরিফের কবিতাই দিয়েই না হয় শেষ করলাম।
শৈশব আমার, হারিয়ে যাওয়া,
সোনালী বসন্ত।
শৈশব আমার, স্বপ্নে পাওয়া,
রাজকীয় রাজতন্ত্র।
শৈশব মানে, স্বাধীন আমি,
আমার হুকুম চলে।
আবার যদি পেতাম ফিরে,
মন কেঁদে কেঁদে বলে।
শৈশবের চাওয়া-পাওয়া,
নেইতো কোন শেষ।
স্মৃতিগুলো মিশে আছে
করে দেয় নিঃশেষ।
কখনো লাটিম, কখনো ঘুড়ি,
কখনো সাঁতার কাটা।
বাবার পকেট চুরি করে,
সিনেমা দেখতে থাকা।
মায়ের বকুনি, প্রতিদিনই খেতাম,
চুরি করতে গিয়ে।
হাঁস, মুরগি, কলা সাফ করতাম,
বাড়ি বাড়ি গিয়ে।
স্কুল ফাঁকি ছিল আমার,
পছন্দের বিষয়।
নদীর পাড়ে সাঁতার কেটে,
কাপড় ময়লা করে, লাগতো শুধু ভয়।
পড়ালেখা আমার কাছে,
ছিল যন্ত্রণাময়।
সন্ধ্যার পরে, পড়তে না বসলে,
বাবা দেখা তো ভয়।
শৈশব তুমি আর একটি বার,
ফিরে আসো না।
তোমার জন্য ব্যাকুল আমি,
মিটিয়ে দাও মনের যাতনা।
(আইএনবি নিউজ)