মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট জালিয়াতিতে তোলপাড়

আইএনবি ডেস্ক নিউজ:বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ও ক্লিয়ারিং পারমিট (সিপি) জালিয়াতির ঘটনায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে তোলপাড় চলছে।

এ ঘটনায় বিস্মিত ও হতবাক চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট সেক্টরের নেতারা। ঘটনাটিকে অত্যন্ত নিন্দনীয় ও জঘন্য আখ্যায়িত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন তারা। এদিকে অভিযুক্ত আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ।

আমদানিকারক রাজধানীর মেসার্স সিয়াম এন্টারপ্রাইজ ও সিএন্ডএফ এজেন্ট চট্টগ্রামের খান এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে আইসিটি অ্যাক্ট এবং পেনাল কোডে আলাদা দুটি মামলা করতে যাচ্ছে কাস্টমস। এছাড়া সিএন্ডএফ এজেন্টের লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এআইআর শাখার সহকারী কমিশনার নূর-এ হাসনা সানজিদা অনূসুয়া বিষয়টি নিশ্চিত করে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমদানিকারক ও তাদের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট চালানটি খালাস প্রক্রিয়ায় তিন ধরনের অপরাধ করেছেন।

প্রথমত, শুল্ক ফাঁকির উদ্দেশে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আনা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, জালিয়াতির মাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভুয়া ওয়েবসাইট খোলা হয়েছে এবং সিপি জালিয়াতি করা হয়েছে। এর মধ্যে মিথ্যা ঘোষণা দেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আগেই ৭৬ লাখ টাকা জরিমানার আদেশ দেয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘যেহেতু ভুয়া ওয়েবসাইটের বিষয় আছে তাই আইসিটি আইনে আমরা একটা এফআইআর করব। কোন ধারায় এটা করা যায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়া সিপি জালিয়াতির মাধ্যমে কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছে।

এটা ফৌজদারি অপরাধের আওতায় পড়ে। এজন্য আলাদা এফআইআর হবে। পণ্য খালাসে নিয়োজিত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের লাইসেন্স বাতিলের জন্য নথি লাইসেন্স শাখায় প্রেরণ করেছি। লাইসেন্স শাখার যে নিয়ম-কানুন রয়েছে সে অনুযায়ী এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারা আমাদের কাস্টমসের লাইসেন্সধারী। এক্ষেত্রে শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

যেভাবে ঘটে জালিয়াতি : চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, ঢাকার চকবাজারের ৬৬ মৌলভীবাজার ঠিকানার মেসার্স সিয়াম এন্টারপ্রাইজ গত ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১৩ হাজার ৫২০ কেজি চিনাবাদাম ও ৪ হাজার ৫১০ কেজি অলিভ অয়েল ঘোষণায় একটি চালান আমদানি করে। আমদানিকারকের পক্ষে চালানটি খালাসের দায়িত্বে ছিল চট্টগ্রাম নগরীর শেখ মুজিব সড়কের প্রগ্রেসিভ টাওয়ারের খান এন্টারপ্রাইজ।

তারা কাস্টম হাউসে চালানের বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। গোপন সংবাদ থাকায় কাস্টম হাউসের অডিট, ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখা আমদানিকারকের বিল অব এন্ট্রি লক করে কায়িক পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়। চালানটির শতভাগ কায়িক পরীক্ষায় ২১ হাজার ৬০ কেজি ঘোষণাবহির্ভূত ‘নেসলে লেকটোগ্রো ফরমুলেটেড মিল্ক পাউডার ফর চিলড্রেন’ পাওয়া যায়। যা আমদানিনীতি আদেশ ২০১৫-১৮ এর অনুচ্ছেদ ১৭ অনুযায়ী শর্তযুক্ত পণ্য।

মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আনার ফলে কাস্টম হাউসের কমিশনার আমদানিকারকের ওপর ৬৬ লাখ টাকা ব্যক্তিগত জরিমানা ও ১০ লাখ টাকা বিমোচন জরিমানা আরোপ করেন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা আমদানি-রফতানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দফতরের সিপি দাখিল সাপেক্ষে চালানটি খালাসের আদেশ দেন। এরপর ১১ অক্টোবর আমদানিকারক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সিপি দাখিল করেন। ১৩ অক্টোবর সিপিবিষয়ক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আরেকটি চিঠি দাখিল করা হয়। দুটি চিঠির মর্মার্থ অনুযায়ী বিএসটিআই’র ছাড়পত্র এবং কমিশনারের বিচারাদেশ অনুযায়ী শুল্ককর ও জরিমানা দেয়া সাপেক্ষে চালানটি খালাসের সিপি দেয়া হয়েছে।

কাস্টমস সূত্র জানায়, চালানটি খালাসে দাখিল করা সিপি এবং অন্যান্য দলিলাদি যাচাইকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিপির হেডিংয়ে যে ওয়েবসাইটের ঠিকানা (www.mincomgov.com) রয়েছে তাতে দাখিল করা সিপি’র কপিও পাওয়া গেছে। তবে শুল্কায়ন গ্রুপের কাছে বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় সিপিতে স্বাক্ষরকারী উপসচিবের সঙ্গে সরাসরি ফোনালাপে জানা যায় দাখিল করা সিপি ভুয়া।

প্রকৃতপক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমদানিকারক বরাবর জারি করা চিঠিতে বলা হয়েছে, ঘোষণাবহির্ভূত আমদানিকৃত পণ্যটি শিশুখাদ্য ও বিএসটিআই’র আওতায় শর্তযুক্তভাবে আমদানিযোগ্য হওয়ায় বিদ্যমান আমদানিনীতি আদেশের চতুর্থ অধ্যায়ের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদের বিধানসমূহ প্রতিপালিত হয়নি বিধায় সিয়াম এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে সিপি ইস্যু করার কোনো সুযোগ নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট হল (www.mincom.gov.bd)

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির ঘটনা মাঝে মধ্যে ঘটে থাকে। সেক্ষেত্রে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার নামে ভুয়া সিপি তৈরি ও তা আপলোড করার জন্য মন্ত্রণালয়ের ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরির ঘটনা নিকট-অতীতে আর ঘটেনি। এটি একটি অভিনব প্রতারণা। এ ঘটনায় কাস্টমস কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে গেছেন।

তবে এত প্রতারণার আশ্রয় নিয়েও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও তাদের নিয়োজিত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট পার পায়নি। তাদের সব অপচেষ্টা রুখে দেয়া হয়েছে।

শুধু কাস্টমস কর্মকর্তারা নন, অন্য সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানগুলোও এ ঘটনায় বিস্মিত। চিটাগং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, ‘এমন ঘটনা নিন্দনীয়। আমরা চাই ভবিষ্যতে আর এ ধরনের ঘটনা না ঘটে। সেজন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আইনগত ব্যবস্থা নিক। তাছাড়া আমাদের সংগঠন এ ধরনের জালজালিয়াতির বিপক্ষে।’

চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘এগুলোকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। আগেও কিছু জালিয়াতি হতো। কিন্তু এ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট জালিয়াতির ঘটনা নজিরবিহীন।

বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে ধনব্যাদ জানাই এজন্য যে, এ ধরনের জালিয়াতি ধরা পড়ছে। যেহেতু নিত্যনতুন জালজালিয়াতির ঘটনা ঘটছে তাই যেসব প্রচলিত আইন বা নিয়ম-কানুন আছে প্রয়োজনে তা আরও যুগোপযোগী করা হোক। বাড়াতে হবে মনিটরিং। ডকুমেন্টেশন সহজ করতে হবে। যেন প্রকৃত ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার না হন।’

এদিকে নগরীর শেখ মুজিব রোডের প্রগ্রেসিভ টাওয়ারের যে ঠিকানা ব্যবহার জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট খান এন্টারপ্রাইজ- সেই ঠিকানায় গিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানে কোনো অফিস পাওয়া যায়নি। ভবন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চার বছর আগে খান এন্টারপ্রাইজ অফিস ছেড়ে চলে গেছে। কয়েক লাখ টাকার ভাড়া বকেয়া রেখেই তারা চলে যায়। যুগান্তর

আইএনবি/বিভূঁইয়া