এলডিসি থেকে উত্তরণ- যত চ্যালেঞ্জে পড়বে বাংলাদেশ

নূর মোহাম্মদ, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

>> ভাবমূর্তির উজ্জলের সুযোগ কাজে লাগত চায় বাংলাদেশ

>> রপ্তানি- ওষুধশিল্পের ধাক্কা সামালে যথেষ্ট প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি

২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এ অর্জন বিশাল পরিসরে উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশের যে আরেক ধাপ উত্তরণ ঘটেছে, তাতে দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা দুটোই অপেক্ষা করছে বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, এলডিসি থেকে বের হলে বাংলাদেশের কিছু বাণিজ্য ও অন্যান্য সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। কিছু সুবিধাও মিলবে। কিন্তু অর্জন করতে হবে। নানামুখী চ্যালেঞ্জে পড়বে বাংলাদেশ। বড় চ্যালেঞ্জ হবে রপ্তানি আয় কমে যাওয়া। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ২০২০ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর রপ্তানি আয় কমবে ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ শুল্কে রপ্তানি করতে হবে বলে আয় কমতে পারে কমপক্ষে ৫১ হাজার কোটি টাকা।

এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দেশগুলোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেশি বলে ধরে নেওয়া হয়। তখন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হতে পারে। এ কারণে বাংলাদেশও এ ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে।
এ ছাড়া এলডিসি হিসেবে যেকোনো দেশ তার দেশে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ওপর নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দিতে পারে। বাংলাদেশ এখন কৃষি ও শিল্প খাতের নানা পণ্য বা সেবায় ভর্তুকি দেয়। এসব ভর্তুকি ও নগদ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করার চাপ আসতে পারে। এমনকি বাংলাদেশ এখন যে রপ্তানি আয় বা রেমিট্যান্স আনায় নগদ সহায়তা দেয়, তা নিয়ে আপত্তি উঠতে পারে।

সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগবে রপ্তানি খাতে

এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হবে রপ্তানি খাতে। কারণ, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা পায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তো আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতেও (যেমন ভারত, চীন) এই ধরনের শুল্কসুবিধা পেয়ে থাকে। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালে এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপির আওতায় এই শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত।

 

এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে এসব বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নিয়মিত হারে শুল্ক বসবে।

সম্প্রতি প্রকাশিতডব্লিউটিওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বাড়তি শুল্কের কারণে রপ্তানি বছরে ৫৩৭ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে।

নানা বিধির কড়াকড়িতে পড়বে ওষুধশিল্প

বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধশিল্প। এলডিসি থেকে বের হলে ওষুধশিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে দিতে হয় না। এর কারণ, মেধাস্বত্বের (পেটেন্ট) ওপর অর্থ দেওয়া হলে ওই ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে।

এ কারণে এলডিসির গরিব নাগরিকেরা স্বল্পমূল্যে ওষুধ পাবে না। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ এই সুবিধা বেশি পেয়েছে। বাংলাদেশ ওষুধশিল্প একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। ২০৩৩ সালের আগে যদি কোনো দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে ওষুধ শিল্পের এই সুবিধা থাকবে না। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এই সুবিধা শেষ হয়ে যাবে।

জাতিসংঘের চাঁদার পরিমান বেড়ে যাবে

এলডিসি থেকে বের হলে জাতিসংঘে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশকে আগের চেয়ে বেশি খরচ করতে হবে। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সরকারি কর্মকর্তারা জাতিসংঘের বিভিন্ন সভায় যোগ দিতে সৌজন্য টিকিট পান। গরিব দেশের কর্মকর্তা হিসেবে এই টিকিট দেওয়া হয়। ২০২৬ সালের পর এ ধরনের বিনা পয়সার টিকিট মিলবে না। আবার আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের বৃত্তি দেয়। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে এ ধরনের বৃত্তির সংখ্যা কমে যাবে।

যেসব খাতে লাভবান হবে

এলডিসি থেকে বের হলে প্রথমে যে লাভটি হবে, তা হলো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। গরিব বা স্বল্পোন্নত দেশের তকমা থাকবে না। পুরোপুরি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হবে।

এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর বাংলাদেশ চড়া সুদে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ নিতে পারবে। সেই টাকা দিয়ে দেশের বড় ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। এমনটি হলে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়বে। এ পর্যন্ত বিশ্বের যতগুলো দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে সবগুলোর ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির নজির রয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। নতুন নতুন ব্যবসায়-বাণিজ্যের দ্বার উন্মোচিত হবে, বেকারত্ব ঘুচবে লাখ লাখ মানুষের। এছাড়া, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহও বাড়বে; সেইসঙ্গে বৃদ্ধি পাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ।

বিশেষজ্ঞরা যা বললেন

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের আইএনবিকে বলেন, ‘এই চ্যালেঞ্জগেুলোকে সুযোগে পরিণত করতে বাংলাদেশকে ধারাবাহিকভাবে কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা উঠিয়ে নিলে কেবল ইইউ থেকেই বছরে ৪ বিলিয়ন ডলার ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখীন হবে বাংলাদেশ।’

সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই উত্তরণের প্রভাব ৪টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পড়বে। এর ফলে বৈশ্বিক বাজারে অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশগম্যতার বিনাশ ঘটবে, বিশেষ ও তারতম্যমূলক বাণিজ্য সুবিধার ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে, ব্যবসাক্ষেত্রে বৈশ্বিক পর্যায়ের কঠোর মান নিশ্চিত করার বিষয়টি সামনে আসবে এবং অ-পারস্পরিক বাণিজ্য সুবিধা কমবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান আইএনবিকে বলেন, এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে রপ্তানি খাত। শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণেই বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে পোশাকশিল্প আজ এই সুদৃঢ় অবস্থানে দাঁড়িয়েছে।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান

পোশাক খাতেই বড় ধাক্কা আসবে। তিনি আরও বলেন, এলডিসি থেকে বের হলে অসুবিধাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আরোপিত হবে। কিন্তু সুবিধাগুলো অর্জন করতে হবে। কারণ, বিনিয়োগ আকর্ষণে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে হবে। অবকাঠামো ও মানবসম্পদ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান আইএনবিকে বলেন, ‘আমরা সাহায্য চাই না, ব্যবসা করতে চাই…এলডিসি থেকে উত্তরণ আমাদের জন্য গর্বের একটি বিষয়। এই উজ্জ্বল ভাবমূর্তির জন্য আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে থেকে তৈরি পোশাকের আরও ভালো দাম পাওয়া যাবে।

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান

তিনি বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ আছে। কিন্তু পোশাক খাত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্যও তৈরি…আমাদের প্রস্তুতির জন্য অনেক সময় আছে। টেক্সাইল খাত দেশীয় পোশাক প্রস্তুতকারকদের আরও বেশি করে কাঁচামাল সরবরাহের জন্য নিজেদের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে ‘

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি তার দপ্তরের আইএনবিকে বলেন, সরকার এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সরকার প্রস্তুতি শুরু করেছে। আমরা এই উত্তরণ চেয়েছিলাম আর শেষ পর্যন্ত তা পেয়েছি। এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ৭টি উপকমিটির সমন্বয়ে গঠিত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি কাজ করছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি

তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য সুবিধাগুলো ধরে রাখতে বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি, অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি ও ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য সম্ভাব্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা করছে। ‘

এনএম/কেআই