আইএনবি ডেস্ক: দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের (১৮৫৮-১৯৪৪) পৈতৃক নিবাস ও জন্মগ্রাম নবীনগরের বিটঘর সুপ্রাচীন কাল থেকেই বিদ্যাশিক্ষায় অগ্রণী ছিল। বিশিষ্ট লোকদের বসবাস ছিল।ছিল উচু বিটি,ছিল বড় বড় ঘর।(বিটঘর নামকরণের ইতিকথা – https://bbariafinder.com/bitghar/)
মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর জীবদ্দশায় বিটঘর গ্রামে মা বাবা ও নিজের নামে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন।কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় এবং ১৯৪৪ সালে পরলোকগমনের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও এ দানবীরের নামে বিটঘর গ্রামে গড়ে উঠেনি কোনো প্রতিষ্ঠান! কেন গড়ে উঠেনি? পাঠকের এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে তৎকালীন সময়ের সামাজিক প্রতিহিংসা ও হীনমন্যতার এক জঘন্যতম চিত্র। দারিদ্রতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় বেশী দূর অগ্রসর হতে না পারলেও বৈষয়িক উন্নতির চেয়ে জ্ঞান চর্চার উন্নতিকেই তিনি মানুষের মুক্তির প্রকৃত উপায় হিসাবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন।তাই নিজের আয়ের অর্ধেক নিয়মিত ভাবে তিনি দান করে গেছেন প্রজন্মের শিক্ষাবিস্তারের পিছনে। তিনি জনকল্যাণে দান করে গেছেন অত্যন্ত নিরবে নিভৃতে।যা আজকের দিনের মানুষেরা কল্পনা ও করতে পারবে না।অথচ এমন মহৎ ব্যক্তি সম্পর্কে আজকের প্রজন্ম,বিটঘরের সাধারণ মানুষ কিছুই জানে না।
হাজার হাজার গরীব ছাত্র/ছাত্রীর জীবন গড়ে তিনি আজ ইতিহাসের পাতায় আমৃত্যু লাভ করেছেন।নানাবিধ ব্যবসায় সফলতার কারণে মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য একসময় কোটি কোটি টাকার মালিক হন। দু’হাতে মানব কল্যাণে দান করেন। তখন জমিদারদের অত্যাচার আর নিপীড়নে সাধারণ প্রজাদের অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। একজন সাধারণ প্রজা হয়ে মহেশ চন্দ্র মানব কল্যাণে প্রবৃত্ত হয়ে কাজ করার কারণে এলাকার জমিদারগণ বিব্রত বোধ করতেন।তাই শত ইচ্ছে থাকা সত্বেও জমিদারদের অসহযোগিতার কারণে নিজ গ্রাম বিটঘরসহ নূরনগর এলাকায় তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ করতে পারেননি।জানা যায়,বিটঘর রাধানাথ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন সকল ব্যয়ভার মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বহন করলেও স্কুলটির নামকরণে জমিদারের ইচ্ছে অনুযায়ী তাদের এক নিকটাত্মীয় রাধানাথের নামে নামকরণ করা হয়।এলাকার নারী শিক্ষার প্রসারে মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর নিজ বাড়ির পাশে ১৯১৫-১৬ সালের দিকে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।প্রভাবশালীদের অসহযোগিতার কারণে সেটিও অকালেই বিলুপ্ত হয়।এই বালিকা বিদ্যালয়ের সকল আসবাবপত্র ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কাইতলা ইংলিশ মাইনর স্কুলে(কাইতলা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়) স্থানান্তর করা হয়।বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’। দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের বেলাও তাই ঘটেছে। তবে এমন প্রতিকূল পরিবেশেও তিনি দমে যাননি।
কাইতলা থেকে কুড়িঘর পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ কিঃ মিঃ মহেশ রোড। মহেশ রোড থেকে বিটঘর বাজার পর্যন্ত সংযোগ রাস্তা। নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষা সংসদ।
বিটঘর গ্রামের লোকের পানীয় জলের অভাব দূরীকরণের জন্য নিজ বাড়ির পাশে একটি পুকুর খনন করেন এবং জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই এখান থেকে পানীয় জল নেওয়ার অনুমতি ছিল। পাকিস্তান আমলে বিটঘর ছিল নূরনগর পরগনার একমাত্র গ্রাম যেখানে বর্ষাকালে নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য তিনটি লোহার ব্রিজ ছিল। এছাড়াও প্রকাশ্যে গোপনে বহু গরীব অসহায় ও কন্যা দায়গ্রস্থ পিতার শেষ আশ্রয়স্থল ছিলেন মহর্ষি মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। উপযুক্ত সহযোগিতা পেলে তাঁর জন্মভিটা, শৈশব-কৈশরের বহ স্মৃতিবিজড়িত বিটঘরে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দাতব্য সংস্থা গড়ে তোলতেন বলে আজ অনেকেই মত প্রকাশ করেন।
শিক্ষা বিষয়ে মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের দর্শন ছিল, ‘একমাত্র শিক্ষাই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে, করে তুলতে পারে আত্মনির্ভর।’ আশার কথা হচ্ছে, বিলম্বিত হলেও এই কিংবদন্তীর দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছেন ওই গ্রামেরই আরেক কৃতিসন্তান ও সমাজ সেবক মোঃ মুন্তাসির মহিউদ্দিন অপু। প্রয়াণের প্রায় ছয় যুগ পর চলতি বছর ২০২০ সালে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কীর্তিমান এ মনীষীর জন্মভূমিতে নৈসর্গিক ও মনোরম পরিবেশে তারই নামানুসারে ‘বিটঘর দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বিদ্যাপীঠ’ প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি পাঠদানের অনুমোদনও পেয়েছে। ‘বিটঘর দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বিদ্যাপীঠ’ এখন শিক্ষা সংস্কৃতিতে পিছিয়ে পড়া জনপদ বিটঘর তথা এলাকার সাধারণ জনগণের মাঝে আঁধারে আলোর দিশা।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে সবিনয়ে একটা কথাই বলতে চাই,এমন মহৎ শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির জীবনী ও তাঁর কর্ম যদি পাঠ্যপুস্তকে অন্তভুক্তি করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরেক মহেশ চন্দ্রের জন্ম এই বাংলাদেশে আর নাও হতে পারে।মানুষকে যদি তাঁর কাজের মূল্যায়ন না করা হয় তাহলে ভালো কাজে মানুষ কখনো উৎসাহী হবে না।
[ দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য: কীর্তিমানের মৃত্যু নেই পান্ডুলিপি থেকে ]
লেখক: এস. এম. শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
আইএনবি/বি.ভূঁইয়া