লাকসামের ‘আয়নাঘরে’ চলতো সাবেক মন্ত্রীর শ্যালকের নির্যাতন

আইএনবি ডেস্ক:নাম ‘মহব্বত’ হলেও আচরণ ছিল নিষ্ঠুর ও মহাজনীসুলভ। বিরোধী দল-মত দমনসহ তার আদেশ-নির্দেশ পালনে ব্যত্যয় ঘটলে কিংবা পান থেকে চুন খসলেই টর্চার সেলে চালাতেন নির্যাতন।

কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনের সাবেক এমপি এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের আপন শ্যালক ও লাকসাম উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মহব্বত ওরফে মহব্বত আলীর কথা। এলাকায় ঠিকাদারি-টেন্ডারবাজী, দখলসহ হেন কোনো কর্মকাণ্ড নেই যা তিনি করেননি।

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ঢাকার আয়নাঘর নামটি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে দেশ-বিদেশে। বন্দিশালায় আটকে রেখে মানুষের ওপর নির্যাতন চালানো এই আয়নাঘরের কথা এতদিন ঢাকায় আছে বলে মানুষের মধ্যে জানা থাকলেও কুমিল্লার লাকসামেও এমন একটি কথিত ‘আয়নাঘর’ ছিল বলে গত কয়েকদিন ধরে চারদিকে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সেখানেও বিরোধী মতের মানুষদের তুলে নিয়ে চালানো হতো নির্মম নির্যাতন। লাকসামের এই আয়নাঘরে অনেক সময় আটকে রেখেও অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে।

সম্প্রতি লাকসাম পৌর এলাকার উত্তর বাজার এলাকায় লাকসাম থানার অপর পাশে অবস্থিত কথিত সেই আয়নাঘরের সামনে ব্যানার টানিয়েছেন নির্যাতিতরা। এরই মধ্যে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই মানুষজন কথিত সেই ‘আয়নাঘর’ দেখতে সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন।

নির্যাতিতদের সঙ্গে কথা বলে এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কথিত যেই আয়নাঘরে ব্যানার টানানো হয়েছে- সেই মার্কেটটির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় টর্চারসেল গড়ে তুলেছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মহব্বত আলী।

মূলত তাজুলের হয়ে লাকসাম এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে লাকসামে মহব্বতই ছিল শেষ কথা। তার কথার বাইরে গেলেই শুরু হতো নির্যাতন ও হয়রানি। কথিত আয়নাঘরের নিচের দুই ফ্লোরে প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় মহব্বতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। গত ৫ই আগস্ট সরকার পতনের দিনই লাকসামের বিক্ষুব্ধ জনতা সেখানে ভাঙচুর চালিয়ে সব মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। আর এতেই মহব্বতের অত্যাচারের অবসান ঘটে। মহব্বতের নেতৃত্বে চলা সেই আয়নাঘরে নির্যাতিতদের একজন লাকসাম পৌরসভা বিএনপি’র যুগ্ম-আহ্বায়ক মনির আহমেদ। মনিরকে একাধিকবার সেখানে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।

মনির আহমেদ বলেন, লাকসামের এই আয়নাঘরের প্রধান জল্লাদের নাম হলো মহব্বত আলী। তিনি তাজুলের শ্যালক হওয়ায় লাকসামকে সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত করেছিলেন। এখানে মহব্বতের সঙ্গে মানুষের ওপর নির্যাতন চালাতেন পৌরসভার সাবেক মেয়র আবুল খায়ের, ইউপি চেয়ারম্যান ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের উপজেলা সভাপতি নিজাম উদ্দিন শামীম, ইউপি চেয়ারম্যান ওমর ফারুকসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের স্থানীয় শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও ক্যাডাররা। ভিন্ন দলের রাজনীতি করায় আমাকে একাধিকবার তুলে নিয়ে সেখানে নির্যাতন চালানো হয়েছে। বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আয়নাঘরের ভবনটির সম্পত্তি নিরীহ মানুষের। মহব্বত তার দুলাভাই মন্ত্রী তাজুলের প্রভাবে সেটি দখলে নিয়ে একরাতের মধ্যেই ভবন তুলতে শুরু করেন। ভবনটির তিনতলার পুরো ফ্লোর এবং ছাদে চারতলায় থাকা একটি কক্ষে চালানো হতো নির্মম নির্যাতন।

তিনি বলেন, বিএনপি’র রাজনীতি করি বলে আমাকে একবার লাকসাম থানার এসআই বোরহান উদ্দিন ধরে নিয়ে মহব্বতের আয়নাঘরে দিয়ে আসে। পরে তিন ঘণ্টা আমাকে একটানা নির্যাতন করে আবার পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। তখন বারবার মনে হচ্ছিল এখনই মনে হয় মরে যাবো। সরকার পতনের পর মানুষ লাকসামের আয়নাঘর নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। এখানে নির্যাতিত মানুষেরাই গত সপ্তাহে ব্যানার টানিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে অনেকে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে লাকসাম পৌর বিএনপি’র শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বলেন, আমাকে তুলে নিয়ে মহব্বত ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী প্রথমে নির্মম নির্যাতন করে। একপর্যায়ে তারা আমার পায়ুপথে গরম চা ঢেলে দেয়। বারবার বৈদ্যুতিক শক দেয়।

লাকসাম হাউজিং এলাকার এক ব্যক্তি বলেন, মহব্বত সবকিছুই করেছেন তাজুল ইসলামের নির্দেশে। আমি হাউজিং এলাকায় বাড়ি নির্মাণের সময় চাঁদা দিতে রাজি হইনি বলে আমাকে তুলে নিয়ে নির্যাতন চালায় মহব্বত বাহিনী। পরে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দিয়ে জীবন রক্ষা করেছি। সেদিনের কথা মনে হলে এখনো ভয়ে কেঁপে উঠি আমি। আমি মনে করি তাজুল ইসলাম ও মহব্বতদের কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার। তারা দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে লাকসামের মানুষকে গোলামের মতো শাসন করেছে। মহব্বত ও তার সহযোগী কামাল হোসেনসহ সংঘবদ্ধরা কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এরমধ্যে কামালের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হলেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়ার খবর পাওয়া যায়নি। তার বাহিনীর সদস্যরা এখন এলাকা থেকে গা-ঢাকা দিয়েছে। মহব্বত কোথায় আছেন কেউ জানে না। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে। এজন্য বারবার চেষ্টা করেও এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। লাকসাম থানার ওসি শাহাবুদ্দিন খান বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তাছাড়া এ বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। সূত্র:মানবজমিন

আইএনবি/বিভূঁইয়া