নবীনগরে সম্পত্তির জন্য বৃদ্ধ মা’কে মারার হুমকি, ছেলের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: পেশাগত দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে গত ২৮ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া নবীনগর উপজেলায় ডাক বাংলার গেইটের সামনে একজন বৃদ্ধা মহিলাকে কাঁদতে দেখা যায়। আমাদের প্রতিবেদক পরিচয় গোপন রেখে তাঁর সামনে গিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার দুই ছেলে সম্পত্তির জন্য দীর্ঘদিন ধরে আমার সাথে খারাপ ব্যবহারসহ বাড়ি থেকে মেরে বের করে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে। আমি বৃদ্ধ বয়সে এইসব মানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত জুন মাসের ১৩ তারিখে নবীনগর থানায় অভিযোগ করেছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন কিছুই হয়নি, তাই থানায় জানাতে এসেছি। যে ছেলেদের এত কষ্ট করে গর্ভেধারণ করে বড় করেছি, সেই তারাই আমার বাড়ি থেকে আমাকে বের করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এই কষ্টের কথা বলার কোন জায়গা নেই। ছেলেদের খারাপ আচরণের কথা গুলো মনে করেই কান্না করছি।

আমাদের প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, বসত বাড়ীটি আমার নিজের নামে। তথাপিও আমার ছেলে হিরু এবং তোফায়েল এলাকার বিভিন্ন স্থানীয় মাতবর ও বর্তমান চেয়ারম্যানকে সাথে নিয়ে আমাকে সম্পত্তি বন্টন করে দিতে বারবার চাপ দিতে থাকে। প্রায় প্রতিদিনই আমাকে এক মানসিক যন্ত্রনার মধ্যে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। গত ২২ জুন ২০১৯ তারিখে আমার ছেলে তাহের উদ্দিন হিরু এবং তোফায়েল গ্রামের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান, বিভিন্ন স্থানীয় মাতবর এবং নবীনগর থানাধীন শিবপুর ফাঁড়ি থেকে পুলিশ এনে আমার বাড়িতে ছায়মানা টাঙ্গিয়ে তাদেরকে দাওয়াত করে খাওয়ান। তখন পুলিশ সহ উপস্থিত সকলেই সম্পত্তি ভাগ করে দেওয়ার জন্য আমাকে বলেন এবং আগামী ১০ দিনের মধ্যে আমার অন্যান্য ছেলে মেয়েকে উপস্থিত রাখতে বলে দেন। ঊনারা বলেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমরা সম্পত্তি বন্টন করে দিব। আমার সম্পত্তি তারা বন্টন করে দেওয়ার কে? কিন্তু আমি বুঝতে পাছিলাম আমার ছেলে হিরুর সব কারসাজি। তাদের এই কথা শুনে আমি বাধ্য হয়ে আমার প্রবাসে থাকা আরেক ছোট ছেলে লিমনের কথা বলি। তাদেরকে আমি বলি আমার ছোট ছেলে প্রবাসে থাকে তার অনুপস্থিতে কি করে সম্পত্তি ভাগ করে দিবেন। তখন উপস্থিত যারা ছিল তাঁরা আমাকে বলে আপনার ঐ ছেলের সাথে আমরা ফোনে কথা বলে নিব।

 


এক পর্যায়ে কান্না জড়িত কন্ঠে তোহেরা বেগম আমাদের প্রতিবেদককে বলেন, বাবা আপনি কে ? তখন আমাদের প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে বলেন আপনি যা বলেছেন আমাদের ক্যামেরার সামনে বলতে পারবেন? উনি বললেন পারব বাবা।

 

তিনি বলেন, আমার বয়স (৬৮) হয়ে গিয়েছে, এই সম্পত্তি কি আমি কবরে নিয়ে যাব? কেন তারা আমার সাথে এই রকম খারাপ আচরণ করছেন বুঝতে পারছিনা। অনেক কষ্ট করে গরমের জন্য পানির তৃষ্ণা মিটাইতে কিছু টাকা জমিয়ে একটা ফ্রীজ কিনেছি তাও আমার ছেলে হিরু যে ঘরে নামাজ পরতাম সেই ঘর থেকে অন্য ঘরে সরিয়ে দিয়েছে। আমি শান্তিমত নামাজও পড়তে পারি না। নামাজের জায়নামাজ ঢিল মেরে ফেলে দিছে। আমার ছোট ছেলে লিমনের একটা আলমারি ছিল সেইটাও ঘড় থেকে বের করে বাহিরে ফেলে দিছে। আমি এবার রমজানে এত্তেকাফে ছিলাম সেখান থেকে এসে আজ পর্যন্ত একটু শান্তি পাই নাই। সবাইতো আমার সন্তান কার কাছে আমি তাদের বিচার দিব বলেই কাঁদতে লাগল।

বৃদ্ধা তোহেরা বেগম বলেন, আমার স্বামী মারা যাওয়ার খবর পেয়েও ছেলে হিরু আসেনি। আমার কোন খোঁজখবর নেয়নি।

মাস খানিক আগে আমি বাধ্য হয়ে ছোট ছেলে লিমনকে অনুরোধ করি দেশে এসে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করে ঝামেলা শেষ করতে। তখন সে চলতি (অক্টোবর) মাসে বাড়িতে আসে।

লিমন বাড়িতে আসার কয়েকদিনপর ছেলে হিরু আমাদের গ্রামের চেয়ারম্যান, মাতবরদের বাড়িতে আসার কথা বললে তাঁরা একটি তারিখ ঠিক করে দিলে আমি আমার সব ছেলে মেয়েদের আসতে বলি। তখন তারিখ মোতাবেক জায়গা বন্টন শুরু হয়। আমরা একপর্যায়ে উনাদের সিন্ধান্ত মেনে নেই। তখন শিবপুর ফাঁড়ির বিবেক নামে পুলিশও উপস্থিত ছিল। কিন্তু যখনই আমার বড় মেয়ে বৈঠকের সবার সামনে বলে উঠে আমার মায়ের ভাগ (অংশ) কই। তখন উপস্থিত সবার সামনে হিরু অকথ্য ভাষায় গালাগালিসহ বটি দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিলে কেউ কোন প্রতিবাদ না করিলে বাকবিতর্কের একপর্যায়ে সবাই চলে যায়।

পরেরদিন গ্রাম্য পুলিশ দিয়ে একটা ষ্ট্যাম্প লিখে আমাদের কাছে পাঠায় সাক্ষর করে দিতে। কিন্তু আগের দিনের কথামত ষ্ট্যাম্পের লেখার কোন মিল না থাকায় আমরা কেউ সাক্ষর করি নাই। তাই আজকে থানায় এসেছি।

এই বিষয়ে আরও কিছু সত্যতার জন্য আমাদের প্রতিবেদক মুঠো ফোনে কথা বলেন তোহেরা বেগমের একজন মেয়ের সাথে । তিনি স্বামী সন্তান নিয়ে রাজশাহীতে থাকেন। উনার কথাও তার মা তোহেরা বেগমের সাথে পুরোপুরি মিল রয়েছে।

তিনি তার মায়ের কথার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমার ভাই তাহের উদ্দিন হিরু এবং তোফায়েল মিলে এইসব করছে। তাদের সাথে আরোও অনেকের যোগসাজস আছে বলে আমি মনে করি। কিন্তু কেউ সঠিক বিচার টুকু করছে না। তবে চেয়ারম্যান মাতবরদের মান রক্ষার্থে শত কষ্ট হলেও তাদের পূর্বের দেওয়া দশ দিনের ভিতরে আমরা উপস্থিত হই। কিন্তু আমরা আসার পর কারোরই কোন খোঁজ খবর নেই। দুদিন অপেক্ষা করার পর আমি বাধ্য হয়ে চেয়ারম্যানকে ফোন দিলে তিনি বলেন আমাদের আসার খবর নাকি জানেন না। আমি তখন উনাকে জানাই আমার আরেক ভাই লিমন প্রবাসে আছে। সে তিন মাস পর দেশে আসবে, তখনই যা করার করব। তাছাড়া আমাদের ছেলে মেয়েদের পরিক্ষা চলছে আমাদের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। তখনকার মত আমরা চলে যাই। পরে লিমন বাড়িতে আসলে আমাদের ডাকালে আমরা আবারও আসি। এবং সম্পত্তি বন্টনের একপর্যায়ে আমার মায়ের অংশ দেওয়ার কথা বললে আমার ভাই হিরু অকথ্য ভাষায় গালাগালিসহ বটি হাতে নিয়ে মারতে আসে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল উপস্থিত কেউই তাকে কিছু বললনা।

তোহেরা বেগমের অনুরোধক্রমে আমাদের প্রতিবেদক তার সাথে নবীনগর থানায় গেলে পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) রাজু আহম্মেদকে বিষয়টি জানালে তিনি সুবিচারের আশ্বাস দিয়ে তাৎক্ষনিকভাবে শিবপুর ফাঁড়ির এসআই বিবেকনন্দকে অভিযোগের সাথে একটা সাদা কাগজে ব্যবস্থা নিতে লিখে তোহেরা বেগমের ছেলে লিমনের হাতে দিয়ে ফাঁড়িতে যেতে বলেন। লিমনও দেরি না করে ফাঁড়িতে গিয়ে এসআই বিবেকের কাছে লিখিত কাগজটি পৌঁছে দেন।

কিন্তু খবর নিয়ে জানা যায় কয়েকদিন চলে যাওয়ার পরও এসআই তেমন ব্যবস্থা না নেওয়ায় আমাদের প্রতিবেদক পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) রাজু আহম্মেদকে ফোন করে জানালে তিনি আজ শনিবার (৯ নভেম্বর) সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাবেন বলে জানান।

তোহেরা বেগমের এখন একটাই দাবী, সে জীবিত থাকা অবস্থায় তাঁর নিজের নামের বসত বাড়িতে কোন ছেলেকেই থাকতে দিবেনা। এবং তিনি তাঁর মৃত স্বামীর সম্পত্তির উপর আইনগত অধিকার চান। বৃদ্ধাবস্থায় তিনি সরকারের কাছে এই দাবী কামনাসহ সুবিচার দাবী করছেন।

উল্লেখ্য, মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, নবীনগর থানাধীন কাইতলা দক্ষিণ ইউনিয়নের কাইতলা গ্রামের মরহুম আলী আহাম্মদ ভূঁইয়ার স্ত্রী তোহেরা বেগম নিজ ছেলে মোঃ তাহের উদ্দিন ভূঁইয়া হিরু (৪২) এবং তোফায়েল আহাম্মদ ভূঁইয়া (৪৭) এর নামে নবীনগর থানায় ১৩/০৬/২০১৩ তারিখে অভিযোগ করেন। যার নং- আর-৮৩১/১৯।

অভিযোগে তোহেরা বেগম উল্লেখ করেন, তাঁর ছেলে তাহের উদ্দিন হিরু এবং তোফায়েল আহম্মেদ ভূঁইয়া অত্যন্ত খারাপ ও উশৃংখল প্রকৃতিক লোক। তারা (ছেলেরা) প্রবাসে ছিল এবং প্রবাসে থাকা অবস্থায় উনার কোন খোঁজ খবর রাখেনি এবং বরন পোষন দেয়নি ।

অভিযোগে তোহেরা বেগম আরও উল্লেখ করেন, আমার স্বামী গত ২০০৯ সালে মৃত্যুবরন করেন। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর হইতে আমি তাহার নামীয় দোকান ভিটি ও সম্পত্তির আয় উপার্জন দিয়া জীবিকা নির্বাহ করি। বর্তমানে বিবাদীদ্বয় প্রবাস হইতে নিজ বাড়িতে আসিয়া অবস্থান করিতেছে। বিবাদীগন প্রবাস হইতে আসার পর থেকেই একচাটিয়া ভাবে আমার স্বামীর নামীয় সম্পত্তি ও বাড়ি তাহাদের নামে লিখিয়া দেওয়ার জন্য আমার উপর চাপ সৃষ্টি করতঃ আমাকে শারীরিক ও মানষিক নির্যাতন শুরু করে। এছাড়াও বিবাদীদ্বয় আমার অপর ছেলে তোজাম্মেল ভূঁইয়াকে বিভিন্ন ভাবে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র করিতেছে। ঘটনার তারিখ ও সময়ে বিবাদীদ্বয় সম্পত্তি ও বাড়ির বিষয়কে কেন্দ্র করিয়া আমাকে বসত ঘর হইতে বাহির হইয়া যাওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। আমি বাহির হইতে না চাইলে বিবাদীদ্বয় আমাকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করে এবং মারধর করিবে মর্মে হুমকি প্রদান করে। বিবাদীদ্বয় এহেন কর্মকান্ডে প্রতিয়মান হয় যে, তাহাদ্বয় যে কোন সময় আমাকে মারধর করিয়া বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দিবে। এমতাবস্থায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করার জন্য অভিযোগে উল্লেখ করেন।

আইএনবি/এম.আর/বি/বিভূঁইয়া