তিনটি সংস্কারের পর নির্বাচন দিতে হবে : সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল

আইএনবি ডেস্ক: বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাজনৈতিক বিরূপ পরিস্থিতিতে সব সময় দলকে সুসংগঠিত রেখেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের নানা দমন-পীড়নের মধ্যে তিনি বরাবরই ছিলেন সোচ্চার। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিষয়ে কালের কণ্ঠকে দেওয়া সাক্ষাৎকার তোলে ধরা হলো-

কালের কণ্ঠ : নির্বাচন ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান বক্তব্য দিয়েছেন।

এই দুজনের বক্তব্য কিভাবে দেখছেন?
মির্জা ফখরুল ইসলাম : সেনাপ্রধান অবশ্যই নির্বাচন চান এবং একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই নির্বাচন চান। ড. ইউনূস, সেনাপ্রধান ও আমাদের বক্তব্যের মধ্যে তেমন তফাত নেই। আমরা যৌক্তিক সময়ের কথা বলেছি। তবে কখনোই যেন যৌক্তিক সময় পার না হয়ে যায়।

নির্বাচন যত দ্রুত করবে, তত সমস্যা কমে যাবে। নির্বাচন আয়োজন যত দীর্ঘায়িত করবে, সমস্যা আরো বাড়বে। যারা বিপ্লব ও পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এবং ফ্যাসিবাদীদের পক্ষে, তখন তারা সেই সুযোগটা নিতে থাকবে।

কালের কণ্ঠ : সেনাপ্রধান ১৮ মাসের কথা বলেছেন।

এটা কী যৌক্তিক সময়?
মির্জা ফখরুল ইসলাম : এটা এ মুহূর্তে বলা খুব মুশকিল। সুনির্দিষ্ট কোনো সময় বলতে চাই না। দেখা যাক, যদি আগে হয়ে যায়, তাহলে আরো ভালো।

কালের কণ্ঠ : সরকারের সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে আপনার মতামত কী?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : এখন সরকার যে সংস্কার ঘোষণা করেছে, সেগুলো প্রয়োজন। নিশ্চিতভাবে দরকার।

আমরাও দুই বছর আগে ৩১ দফা দিয়ে ওই সব সংস্কারের কথা বলেছি। সংস্কার কমিটিতে যাঁদের দিয়েছেন, তাঁরা যোগ্য মানুষ। একই সঙ্গে জনগণ কী চায় সেটা তাঁদের দেখতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাঁদের কাছে জানতে হবে, কাদের কী প্রস্তাব আছে না আছে। এ বিষয়ে একটি ঐকমত্য তৈরি করতে হবে। সেই ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা সংস্কারগুলো চাই।
কালের কণ্ঠ : বিএনপি কোন কোন বিষয়ে সংস্কার চায়?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : নির্বাচনপ্রক্রিয়া, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ—এই তিনটি সংস্কার করে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারলে নির্বাচনটা খুব সুন্দরভাবে করা যাবে। আমরা দ্রুত এই তিনটি সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন চাই।

কালের কণ্ঠ : বিএনপি যে জাতীয় সরকারের কথা বলছে, সেটি কিভাবে হবে?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : আমরা এরই মধ্যে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করার কথা বলেছি। বিভিন্ন দেশে এ ধরনের জোট করে সরকার গঠন হয়েছে। তবে জাতীয় সরকার নিঃসন্দেহে জটিল প্রক্রিয়া। নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করল, তাদের নিয়ে একটি বিষয় আছে। সেখানে যদি আওয়ামী লীগ অংশ নেয়, তাহলে আরেকটি ব্যাপার আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিয়ে তো সরকার গঠন করা যাবে না। কারণ, তারা রাষ্ট্রদ্রোহী ও দেশবিরোধী কাজ করেছে। তাদের নিয়ে সরকার গঠনের প্রশ্নই উঠতে পারে না। এ জন্য আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো নিয়ে সরকার গঠন করা হবে।

কালের কণ্ঠ : সেই সরকারে কী জামায়াত থাকবে?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : তারা যদি সেভাবে আসে, তাহলে আন্দোলনকারী দলগুলো চিন্তা করে দেখবে। তখন আলোচনা করে দেখব। এখনই চূড়ান্ত মন্তব্য করতে চাই না।

কালের কণ্ঠ : আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া যাবে না—এমন বক্তব্য আসছে বিভিন্ন মহল থেকে। আপনি কী মনে করেন?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : নির্বাচন করতে না দেওয়ার বিষয়ে আমি একমত না। আপনি নির্বাচন করতে দেবেন না কেন? জনগণ বিচার করবে আওয়ামী লীগ থাকবে কি থাকবে না। এই যে রাজনীতিতে একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে, এ নির্বাচন করতে পারবে না, ও নির্বাচন কতে পারবে না। ওকে নিষিদ্ধ করতে হবে। যেমন জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করল। এটা কখনো ঠিক হয়নি। তার প্রমাণ হলো, জামায়াত তো আমার সামনে চলে এলো। আমি আওয়ামী লীগকে যতটুকু বুঝি, তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।

কালের কণ্ঠ : গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের নির্বাচন করতে দেওয়া না-ও হতে পারে। তাতে কী পরিস্থিতি দাঁড়াতে পারে? আপনি কি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : আমি ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পক্ষে না। কোনো রাজনৈতিক দলই নিষিদ্ধের পক্ষে না। আমার ব্যক্তিগত মতামত গণতন্ত্রকে গণতন্ত্রের মতো চলতে দিতে হয়। গণতান্ত্রিক চর্চা রাখতে হবে। একটি ফ্যাসিবাদী দল নিষিদ্ধ করলাম। তারপর সে ভিন্ন চেহারা নিয়ে ফিরে আসতে পারে।

কালের কণ্ঠ : নির্বাচনের জন্য বিএনপি কতটা প্রস্তুত?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : আমরা নির্বাচনের জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকা দল। কারণ, এই দল তো ক্ষমতায় যাওয়ার দল, ক্ষমতায় যাবে।

কালের কণ্ঠ : অন্তর্বর্তী সরকারের কী স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা উচিত হবে?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : আমি মনে করি না। এই সরকারের উচিত হবে শুধু জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা।

কালের কণ্ঠ : বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছু ক্ষেত্রে সংবিধান পরিবর্তনের কথা উঠেছে। এ বিষয়ে আপনি কি মনে করেন?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : সংবিধান তো অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। এই সংবিধান তো একেবারে শেষ করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ। সংবিধানের যে অবস্থা, তাতে নতুন করে লেখা উচিত। সেটা করবে নির্বাচিত সরকার।

কালের কণ্ঠ : পুলিশ বাহিনীকে কিভাবে পুনর্গঠন করা যেতে পারে?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : যারা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, সবাইকে চাকরিচ্যুত করতে হবে। যাদের রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত রাখা হয়েছে, তাদের দ্রুত ফেরাতে হবে। অতি দ্রুত নিয়োগ করতে নতুন নিয়োগ দিতে হবে, তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রশিক্ষিত করতে হবে।

কালের কণ্ঠ : ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কিভাবে দেখছেন? কেউ বলছেন, পুরো অবদান ছাত্রদের। আপনাদের ৪২২ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। তাহলে কী দাঁড়াল?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : আমি মনে করি, সবার অবদান আছে। সাধারণ জনগণ পরিবর্তন চেয়েছে। তারা সরকারের ওপর বিরক্ত ছিল। আমরা এই আন্দোলনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বিশাল আকারে ছিলাম। তার মানে এই না বিএনপির সব করে ফেলেছে, সে কথা তো বলছি না। আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের হয়েছে বলে আমরা জানা নেই। যারা এখন ক্রেডিট নেওয়ার জন্য বলে বেড়াচ্ছেন—এটা একটা সংকীর্ণ রাজনীতি। এটি ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন।

কালের কণ্ঠ : ৫ আগস্টের পর অনেক মহলে বিএনপিবিরোধী একটি মনোভাব দেখা যাচ্ছে। এর কারণ কী?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। আমরা ওয়ান-ইলেভেনের গন্ধ পাচ্ছি, বিরাজনীতিকরণের গন্ধ পাচ্ছি। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। রাজনীতি বাদ দিয়ে বাংলাদেশ কিছু সম্ভব না।

কালের কণ্ঠ : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, পরের নির্বাচন বিএনপির জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। আপনি কি মনে করেন?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : বাংলাদেশে আগে মাইনাস টুর যে পরিকল্পনা ছিল, সেটা এখনো আছে। আমরা বিশ্ব রাজনীতির মধ্যে পড়ে গেছি। ভারত আমাদের প্রতিবেশী, চীনেরও বাংলাদেশকে নিয়ে আগ্রহ আছে, মায়ানমারও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জড়িত, যুক্তরাষ্ট্রেরও বাংলাদেশকে নিয়ে আগ্রহ আছে। বিএনপির বিরোধিতার পেছনে সে বিষয় কাজ করে। কারণ জাতীয়তাবাদী শক্তিকে বাইরের লোকেরা পছন্দ করে না।

কালের কণ্ঠ : তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রক্রিয়া কী?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : দেশে ফেরার দুটি পথ আছে। প্রথম বিষয়টা হচ্ছে তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। মামলা প্রত্যাহারে সরকারের অঙ্গীকার আছে।

কালের কণ্ঠ : জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব আছে কি?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : কোনো দূরত্ব নেই। বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতি সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের চিন্তা ও আদর্শ উদ্দেশ্য আলাদা। যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তারাই বিএনপি-জামায়াতকে ব্র্যাকেটবন্দি করতে চায়। আমরা রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে নির্বাচন ও আন্দোলনে জয়ী হতে জোট করেছি।

কালের কণ্ঠ : জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট থাকবে কি না?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : এটি এখনই বলা যাবে না। নির্বাচনের আগে জনমত দেখব। এককভাবে করলে ভালো হলে তাই করব। জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করা ভালো হলে সেটিও করতে পারি।

কালের কণ্ঠ : ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠন করতে চায়। অনেকে বলছেন, এটি হবে কিংস পার্টি। এ বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : বাংলাদেশে এর আগে এ ধরনের চেষ্টা বহুবার করা হয়েছে। রাজনৈতিক দল সাধারণত আন্দোলন সংগ্রাম থেকে উঠে আসে। এটা তার মূল ভিত্তি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠন করতে হলে আলাদা বিপ্লবের বিষয় থাকে। কিন্তু এখানে দল গঠনের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত জনগণের সমর্থন।

কালের কণ্ঠ : সংখ্যানুপাত পদ্ধতিতে নির্বাচন চান?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : আমরা এটাকে সমর্থন করব না। বাংলাদেশে এই পদ্ধতির চর্চা নেই। সুতরাং এটি এবারের নির্বাচনে প্রয়োগের প্রশ্নই ওঠে না।

কালের কণ্ঠ : আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তারা রাজনীতিতে আবার ফির আসতে পারে, নির্বাচনেও আসতে পারে। কিন্তু জনগণের মধ্যে ফেরার সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে কম দেখছি।

কালের কণ্ঠ : দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : আওয়ামী লীগ সরকারের বড় বড় ঘটনাগুলোর সঙ্গে কিছু শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী জড়িত ছিলেন। তাঁদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ৫০-৬০ হাজার লোক কাজ করে। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো যদি আমরা বন্ধ করে ফেলি, তাহলে কিন্তু দেশের শিল্পোৎপাদন স্থবির হয়ে যাবে। অর্থনৈতিক সমস্যা হবে। বেকারত্ব বেড়ে যাবে। হয়তো সরকার সেই বিষয়টি চিন্তা করছে।

কালের কণ্ঠ : বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল করার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আমাদের যত দ্রুত সম্ভব কাউন্সিল প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। সেটা নির্বাচনের আগেই করা যেতে পারে।
কালের কন্ঠ

আইএনবি/বিভূঁইয়া